থ্রিডি এনিমেশন কাজে আগ্রহি ব্যক্তির অভাব নেই। সংখ্যায় হাজার ছাড়িয়ে লাখের ঘরে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে থ্রিডি কাজ করার কোন ষ্টুডিও কিংবা শেখানোর কোন প্রতিষ্ঠানের কোন নাম কি করতে পারেন যার একনামে পরিচিতি রয়েছে ?
নেই। এমন না যে থ্রিডি এনিমেশনের কাজ হচ্ছে না। যথেষ্ট পরিমানে হচ্ছে। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে তো বটেই, ইদানিং ভিডিও স্পেশাল ইফেক্ট হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে। তারপরও, এনিমেশন কাজের জন্য পরিচিত ষ্টুডিও কিংবা শিক্ষা প্রতিস্ঠান নেই। এই অবস্থার মধ্যে যারা শিখছেন, কাজ করছেন, তারা শিখছেন নিজের মত করে। তাদের কারো কারো সাথে হয়ত এনিমেশনের মুল বিষয়ের বড় রকমের গড়মিল থেকে যাচ্ছে।
যদি আপনি আগ্রহি হন, যদি এমনই হয় আপনি একাজ করবেনই করবেন, তাহলে আপনার প্রথম শিক্ষা, শিখতে হবে নিজে। অন্যান্য অনেকের মত কেউ একবার দেখিয়ে দিলেই শিখে ফেলব এই আশা করে সময় ক্ষেপন করবেন না। নিজে যদি শিখতে না পারেন তাহলে বাস্তবতা স্বিকার করুন, হয়ত থ্রিডি এনিমেশন আপনার জন্য না। পুরোপুরি নিজে শেখা কঠিন, কারো সহযোগিতা থাকলে সুবিধে হয়। সেজন্যই এই লেখা।
শেখার সাথে সম্পর্ক প্রশ্নের। প্রশ্ন করবেন, তার উত্তর থেকে শিখবেন এটাই নিয়ম। প্রশ্ন করতে শুরু করুন।
কেন শিখবেন ?
শখ, ভাল লাগে, দেখি না কিভাবে কাজ হয় ...... এধরনের মনোভাব যদি থাকে তাহলে থ্রিডি এনিমেশনের কথা ভুলে যান। শখ করে এনিমেটর-প্রোগ্রামার এসব হওয়া যায় না। দিন কখন শুরু হয়, কখন শেষ হয় এসব ভুলে যদি কম্পিউটারের সামনে দিনরাত কাটানোর মনোবল থাকে তবেই সামনে এগোন।
এখনও এই লেখা পড়ছেন দেখে ধরে নিচ্ছি সেটা আপনার আছে। আপনি এনিমেশনকে পেশা হিসেবে নিতে চান। একইসাথে শখ পুরন হবে, সৃষ্টিশীল কিছু করবেন, সুনাম কুড়াবেন এবং সেইসাথে যথেষ্ট পরিমান অর্থ উপার্জন করবেন। তাহলে বাস্তবে দেখা যাক কি করা যায়।
আগেই একবার উল্লেখ করা হয়েছে বিজ্ঞাপনের কথা। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কাজ হয় বিজ্ঞাপনে। সবথেকে বেশি আয়ও আসে এদিক থেকেই। প্রথম লক্ষ্য হতে পারে সেটাই। একটি সাবান কিংবা পানির বোতল তৈরী করা তুলনামুলক সহজ কাজ। তাকেই প্রথম টার্গেট করতে পারেন। সেইসাথে টিভিতে যাকিছু বিজ্ঞাপন দেখানো হয় তার সবই করতে পারবেন এটা ধরে নেবেন না, অন্তত শুরুতে। অনেক বিজ্ঞাপনই অন্য দেশ থেকে করে আনা হয়।
টিভি যাকিছু অনুষ্ঠান দেখানো হয় তাতে কিছু এনিমেশনের বিষয় থাকে। শুরুতে এবং শেষে তো বটেই, ভেতরেও। হলিউডের মত থ্রিডি মুভি তৈরী হয়না, সিনেমায় থ্রিডি স্পেশাল ইফেক্টের ব্যবহার চালু হয়নি, বাংলাদেশের টিভির খবরে বিবিসি-সিএনএন এর মত এনিমেশন ব্যবহার হয় না একথা বলেও বলতে হয় কিছু তৈরী এনিমেশন ব্যবহার করা হয়, আগামীতে ব্যবহার আরো বৃদ্ধি পাবে। এদিকেও দৃষ্টি দিতে পারেন।
যদি দল গড়তে পারেন তাহলে নিজেই পুরো এনিমেশনের কাজে হাত দিতে পারেন। এনিমেটেড বিজ্ঞাপন, এমনকি কয়েক মিনিটের এনিমেটেড মুভি। বলিউডে সম্প্রতি তৈরী হয়েছে টুনপুর কা সুপার হিরো। এই মানের এনিমেশন বাংলাদেশে করা সম্ভব। মনে করিয়ে দেয়া যেতে পারে, বেশ কয়েক বছর আগে মন্টুমিয়া তৈরী হয়েছিল। বিষয়টি সামনের দিকে যায়নি। কাজেই সেকাজ খুব সহজ ধরে নেবেন না। স্পন্সর যদি মনে করে এনিমেশনের থেকে ভিডিওর দাম বেশি তাহলে মনের দুঃখ মনে চেপে সামনে এগোতে চেষ্টা করবেন।
লক্ষ্য যখন ঠিক হয়েই গেছে তখন কাজের ধরনের দিকে একবার দৃষ্টি দেয়া যাক, সংক্ষেপে।
এনিমেশনের জন্য মডেল তৈরী করা এক কাজ, সেগুলিকে পছন্দমত রঙচঙে করা আরেক কাজ, বিভিন্ন দিকে লাইট-ক্যামেরা বসানো আরেক কাজ এবং সেগুলোর নড়াচড়া (মুল এনিমেশন) আরেক কাজ। এর প্রতিটি কাজই এতটা জটিল হতে পারে যে একার পক্ষে সবকাজ করা সম্ভব হয় না। এনিমেশন ষ্টুডিওতে ভিন্ন ভিন্ন কাজ ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি করে। মডেলারের কাজ শুধুমাত্র মডেল তৈরী করা, এনিমেটরের কাজ তৈরী জিনিষগুলি এনিমেট করা। সম্ভব হলে দল গড়ুন এবং প্রত্যেকের কাজ আগেই নির্দিষ্ট করে দিন।
যদি একাই সব কাজ করতে চান তাহলে কখনো বড়কাজের সুযোগ পাবেন না। জানেন নিষ্চয়ই, আপনি একা পুকুর কাটতে পারেন না। বড়জোর একটা গর্ত বানাতে পারেন।
যদি একা কাজ করতেই হয় তাহলে আরেকটি দিক হতে পারে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে বিদেশের কাজ করা। থ্রিডি মডেল তৈরীতে দক্ষ হলে ঘরে বসে কাজ করতে পারেন। আয় সম্পর্কে কিছুটা ধারনা দিতে পারি, একটি ক্যারেকটার মডেল করার জন্য পাবেন কমপক্ষে ১০০ ডলার, সময় লাগবে ১ থেকে ২ দিন।
শিখবেন কিভাবে সেটা একবার দেখে নেয়া যাক।
প্রতিটি সফটঅয়্যাররের নিজস্ব হেল্প এবং টিউটোরিয়াল থাকে। কখনো সফটঅয়্যারের সাথে ইনষ্টল হয়, কখনো ইন্টারনেট থেকে ব্যবহার করতে হয়। এগুলি যারা তৈরী করেন তারা এবিষয়ে বিশেষজ্ঞ। কোন ধাপের পর কোন ধাপ সবচেয়ে উপযোগি সেটা জেনেই এগুলি তৈরী করা হয়। শেখার সময় এবং কাজের সময় সবচেয়ে বেশি কাজে আসবে এগুলিই। এছাড়া রয়েছে বই। বর্তমানে ইন্টারনেট থেকে বিশ্বসেরা বইগুলিও সংগ্রহ করা যায় বিনামুল্যেই। প্রতিটি সফটঅয়্যারের রয়েছে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য ব্যবহারকারী, তাদের রয়েছে ফোরাম। বহু টিউটোরিয়াল রয়েছে বিভিন্ন ওয়েব সাইটে। এর বাইরে কোন সমস্যায় পড়লে ফোরামের সদস্যরা সরাসরি সাহায্য করতে রাজি। এতকিছু থাকতে শেখার উপকরনের সমস্যা হওয়ার কথা না।
তাই বলে আপনি বিশ্বসেরা হবেন এটাও ধরে নেবেন না। এনিমেশনের জব সাইটে গেলে লক্ষ করবেন এধরনের পদের জন্য পিএইচডি খোজ করা হয়। সেইসাথে বহু বছরের অভিজ্ঞতা। নিজের অবস্থান কি জেনে চলাই ভাল। একজন বাংলাদেশি এনিমেটরের সাক্ষাতকারের কথা মনে পড়ছে যিনি এনিমেটেড মুভি তৈরী করে অস্কার পাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন ঘুমিয়ে দেখা ভাল, দিবাস্বপ্ন না দেখাই উত্তম।
শুরু করবেন কোথায় ?
শুরু করতে পারেন ভিডিও টিউটোরিয়াল দিয়ে। লিনডা, টোটাল ট্রেনিং, ডিজিটাল টিউটর, ভিটিসি, কেলবি এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে উন্নতমানের ভিডিও টিউটোরিয়াল। ইন্টারনেট থেকে ব্যবহার করা যায়, ডিভিডি হিসেবে পাওয়া যায়। অত্যন্ত সহজবোধ্য এই টিউটোরিয়ালগুলিকে শেখার প্রথম ধাপ হিসেবে ব্যবহার করুন। কিছুটা সাহায্য পাবেন এই সাইট থেকে। তাহলেও, অন্য টিউটোরিয়ালের দিকে দৃষ্টি রাখুন। সফটঅয়্যারের সাথে যে টিউটোরিয়ালগুলি দেয়া হয় সেগুলি নিজে করে দেখুন।
যে কথা শুরুতে আশা করেছিলেন সেকথা বলা যাক শেষে। কোন সফটঅয়্যার শিখবেন।
থ্রিডি ষ্টুডিও ম্যাক্স অথবা মায়া। যে কোন একটি। মায়া তুলনামুলক উন্নত। এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা ম্যাক্সে করা যায় না। যদি আপনি সেই পর্যায়ে কাজ করেন। ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না, এই পর্যায়ের কাজ বাংলাদেশে সাধারনত হয় না। হলিউডের কথা আলাদা। যেখানে প্রয়োজনে বিশেষ কাজের উপযোগি সফটঅয়্যার তৈরী করে নেয়া হয়। তারপরও, যদি অংকে যথেষ্ট ভাল হন তাহলে মায়া ব্যবহার করতে পারেন। কারন, দুঃখজনক সত্য হচ্ছে ক্লায়েন্টের মনোভাব। তাদের অনেকেই সবজান্তা। যার কাজ করবেন তিনি বিশেষজ্ঞের মত বলতে পারেন, আপনি কোন সফটঅয়্যারে কাজ করবেন ? ম্যাক্স! ধুর ওটা কোন সফটঅয়্যার হল!
আপনার কাছে কাজ যদি একমাত্র গুরুত্বপুর্ন বিষয় হয় তাহলে অন্যদিকে না তাকিয়ে থ্রিডি ষ্টুডিও ম্যাক্স ব্যবহার শুরু করুন। বাংলাদেশে এমন বিশেষজ্ঞ পাবেন না যিনি কাজ দেখে বলতে পারেন কোন কাজ ম্যাক্সে কোন কাজ মায়ায় করা। বাংলাদেশের বর্তমান কাজ, ভবিষ্যতের কাজ কিংবা এনিমেটেড মুভি এসবের জন্য থ্রিডি ষ্টুডিও ম্যাক্স যথেষ্ট। এটা তুলনামুলক সহজ। কেউ যদি মিথ্যে শুনতে চায় প্রয়োজনে মিথ্যে বলুন।
ভুলেও একসাথে দুটোতে হাত দেবেন না। এটা না ওটা বলে সময় নষ্ট করবেন না। ম্যাক্সে যদি সত্যিকারের দক্ষ হতে পারেন পরবর্তীতে মায়া কিংবা সফটইমেজ, লাইটওয়েভ যাই বলুন না কেন শিখতে সমস্যা হওয়ার কথা না।
কোন ভার্শন শিখবেন জানতে চান ?
এটা আদৌ কোন প্রশ্ন না। টার্মিনেটর ২ যখন তৈরী করা হয় তখন থ্রিডি ষ্টুডিও ম্যাক্স নামে সফটঅয়্যার ছিল না, ছিল থ্রিডি ষ্টুডিও নামে ডস অপারেটিং সিষ্টেমের সফটঅয়্যার। বর্তমানের যে কোন ভার্শন তারথেকে অনেক অনেক অনেক বেশি উন্নত।
কি কম্পিউটার প্রয়োজন প্রশ্ন করতে পারেন। দ্রুত রেন্ডারিং এর জন্য শক্তিশালী প্রসেসর, বেশি মেমোরী, ভাল গ্রাফিক্স কার্ড এগুলি প্রয়োজন হয়। যতটা সম্ভব ভাল কেনার চেষ্টা করুন। যদি সম্ভব না হয়, যা আছে তাতেই কাজ করা সম্ভব।